চৈতন্য মহাপ্রভুর দৃষ্টিতে ইসলাম ও গোহত্যা
আলোচ্য ঘটনাটি চৈতন্য চরিতামৃত, আদি লীলা, অধ্যায় ১৭-তে বর্নিত:-
যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাজীর বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি দরজার কাছে বসে পড়লেন এবং কিছু সম্মানীয় ব্যক্তিকে কাজীকে ডাকতে পাঠালেন।
কাজী যখন এলেন, মাথা নিচু করে এলেন, তখন প্রভু তাঁকে যথোচিত সম্মান ও আসন দিলেন।
বন্ধুভাবাপন্নভাবে প্রভু বললেন, “হুজুর, আমি আপনার বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছি, কিন্তু আমাকে দেখে আপনি ঘরের ভিতরে লুকিয়ে পড়েছেন। এটা কেমন শিষ্টাচার?”
কাজী বললেন, “আপনি আমার বাড়িতে খুব রাগান্বিত মেজাজে এসেছেন। আপনাকে শান্ত করতে আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনার সামনে আসিনি, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
“এখন আপনি শান্ত হয়েছেন, আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনার মতো একজন অতিথি পাওয়া আমার সৌভাগ্য।
“আমাদের গ্রামের আত্মীয়তার সম্পর্কে, নীলাম্বর চক্রবর্তী ঠাকুর ছিলেন আমার কাকা। এই সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও দৃঢ়।
“নীলাম্বর চক্রবর্তী আপনার মাতামহ, এই সম্পর্ক অনুযায়ী আপনি আমার ভাগ্নে।
“যখন ভাগ্নে খুব রেগে যায়, তখন মামা সহিষ্ণু হয়, আর যখন মামা কোনো অপরাধ করে, ভাগ্নে তা গুরুত্ব দেয় না।”
এইভাবে কাজী ও প্রভু ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে নানা কথা বললেন, কিন্তু বাইরের কেউ তাদের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারল না।
প্রভু বললেন, “প্রিয় মামা, আমি আপনার ঘরে এসেছি কিছু প্রশ্ন করার জন্য।”
প্রভু বললেন, “আপনি গরুর দুধ পান করেন, তাই গরু আপনার মা। আর বল আপনার জন্য শস্য উৎপাদন করে, তাই সে আপনার বাবা।
“যেহেতু বলদ ও গরু আপনার পিতা-মাতা, আপনি কিভাবে তাদের হত্যা করে খান? এটা কেমন ধর্মনীতি? কী ভরসায় আপনি এমন পাপ কাজ করছেন?”
কাজী বললেন, “আপনাদের যেমন বেদ ও পুরাণ নামক শাস্ত্র আছে, আমাদের তেমন পবিত্র কোরআন নামক শাস্ত্র আছে।
“কোরআন অনুসারে দুটি পথ আছে উন্নতির—ভোগপ্রবৃত্তি বৃদ্ধির পথ ও ভোগপ্রবৃত্তি হ্রাসের পথ। নিবৃত্তি-মার্গে পশুহত্যা নিষিদ্ধ।
“কর্মের পথে গরু হত্যা নির্দিষ্ট নিয়মে বৈধ। যদি শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী তা করা হয়, তবে পাপ হয় না।”
একজন বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে কাজী চৈতন্য মহাপ্রভুকে চ্যালেঞ্জ করে বললেন, “আপনাদের বৈদিক শাস্ত্রেও গরু হত্যার বিধান আছে। এই বিধানের ভিত্তিতে অনেক ঋষি যজ্ঞে গরু হত্যা করেছেন।”
কাজীর এই বক্তব্য খণ্ডন করে প্রভু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “বেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে গরু হত্যা করা যাবে না। তাই প্রত্যেক হিন্দু, সে যেই হোক, গরু হত্যা এড়িয়ে চলে।
“বেদ ও পুরাণে বলা আছে—যদি কেউ কোনো প্রাণীকে জীবিত করতে পারে, তবে পরীক্ষামূলকভাবে হত্যা করা যেতে পারে।
“এই কারণে বড় বড় ঋষিগণ কখনো কখনো বৃদ্ধ গরুকে হত্যা করতেন এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের পুনরুজ্জীবিত করতেন।
“বৃদ্ধ ও অক্ষম গরুর এই হত্যা ও পুনর্জীবন আসলে হত্যা নয়, বরং একটি মহৎ কর্ম ছিল।
“আগে এমন শক্তিশালী ব্রাহ্মণ ছিলেন যারা বৈদিক মন্ত্রের সাহায্যে এমন পরীক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু এখন কলিযুগে ব্রাহ্মণরা এত শক্তিশালী নন। তাই এখন গরু বা বলদের পুনর্জীবনের উদ্দেশ্যে হত্যা নিষিদ্ধ।
“এই কলিযুগে পাঁচটি কর্ম নিষিদ্ধ: অশ্বমেধ যজ্ঞ, গো-যজ্ঞ, সন্ন্যাস গ্রহণ, পিতৃদের জন্য মাংস অর্ঘ্য দেওয়া, এবং ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে সন্তান উৎপাদন।
“আপনারা মুসলমানেরা যেহেতু নিহত গরুকে জীবিত করতে পারেন না, তাই গরু হত্যার দায় আপনাদেরই। তাই আপনারা নরকে যাচ্ছেন; আপনাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই।
“যতগুলো লোম গরুর গায়ে আছে, তত সহস্র বছর ধরে গরু হত্যাকারীরা নরকে পচে থাকে।
“আপনাদের শাস্ত্রে অনেক ভুল ও বিভ্রম আছে। সেই গ্রন্থকারেরা প্রকৃত জ্ঞান না জেনে এমন আদেশ দিয়েছেন যা যুক্তিবিরোধী ও অপ্রমাণিত।”
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এইসব কথা শুনে কাজী স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তার সব যুক্তি থেমে গেল, তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। পরিশেষে, ভালোভাবে চিন্তা করে, তিনি পরাজয় স্বীকার করলেন এবং বললেন—
“প্রিয় নিমাই পণ্ডিত, আপনি যা বলেছেন, সবই সত্য। আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলি সদ্য সৃষ্টি হয়েছে এবং অবশ্যই তা যুক্তিসঙ্গত বা দার্শনিক নয়।
আমি জানি, আমাদের গ্রন্থগুলো কল্পনাপ্রসূত ও বিভ্রান্তিমূলক ধারণায় পরিপূর্ণ, তবুও আমি মুসলমান হওয়ায় আমার সমাজের স্বার্থে সেগুলো মেনে নিই, যদিও এতে যথেষ্ট যুক্তি বা প্রমাণ নেই।”
এখান থেকে চৈতন্য মহাপ্রভুর ইসলাম ও গরু হত্যা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট বোঝা যায়।
যারা বলে যে বৈদিক যুগে যজ্ঞে গরু হত্যা হতো, তাদের এই দাবির জবাবে চৈতন্য মহাপ্রভুর ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে শক্তিশালীভাবে খন্ডন করা যায়।
বেদে গো বধ প্রসঙ্গে অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম এই নিয়ে লিখবো। কেউ বলবে এতো অলৌকিক ব্যাখা চৈতন্যদেবের। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে প্রসঙ্গ যখন বেদ তখন শুধু ইতিহাসের চোখ দিয়ে সম্পূর্ণ দেখা ভুল কারণ যেকোনো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ যা ঈশ্বরের বাণী হিসেবে ধরা হয় তাতে অলৌকিক তত্ব থাকেই। সুতরাং ইতিহাস প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক চরিত্র ও বাঙালির অন্যতম মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর দৃষ্টিকোণ ও জরুরী জানা তাই নয় কি। আর এই ব্যখ্যা শুধু চৈতন্যদেবের নিজের নয়। কোনো একটি পুরাণেও এই ব্যখ্যা লক্ষ্য করেছিলাম। এবাদে বহু স্মৃতিতে সত্যি কলি যুগে গোমেধ জাতীয় যজ্ঞ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আরও মাথায় রাখতে হবে যদি এই ব্যখ্যা শাস্ত্রের না ধরেন মনে রাখবেন (ঋগ্বেদ VIII.101.16)-এ গাভীকে ‘দেবী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
ঋগ্বেদেই গাভীকে বারবার ‘অঘ্ন্যা’ (অর্থাৎ, যাকে মারা যাবে না) বলে অভিহিত করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:—
* ঋগ্বেদ I.164.27 ও I.164.40,
* ঋগ্বেদ IV.1.6,
* ঋগ্বেদ V.83.8,
* ঋগ্বেদ VIII.69.21,
* ঋগ্বেদ X.87.16
এইসব মন্ত্রে গাভীর হত্যা নিষিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, এবার আপনারাই বলুন যদি বৈদিক যুগে গো-বধ মেনে নেন তাহলে এই মন্ত্র গুলোর কি ব্যখ্যা দেবেন ? Contradictions এসে যাবে। তাই শাস্ত্র পারস্পারিক বেদ ভাষ্য ও ব্যখ্যা দ্বারা বোঝা উচিৎ।
Comments
Post a Comment