[শম্বুক বধের আসল কারণ]

শম্বুক-বধ হল একটি সাধারণ ঘটনা যা রামায়ণ এবং হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য পেঁচানো হয়েছে। অনেকে মানসিক জিমন্যাস্টিক করেন কিন্তু ব্যাখ্যা খুঁজে পান না। যাইহোক, নিষ্ঠার সাথে, ঠিক ভাবে পড়লে আমরা রামায়ণেই ব্যাখ্যা খুঁজে পাই।

এই ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক। ভগবান রাম শম্বুককে কেন হত্যা করেছিলেন? শম্বুক কি বললেন? এই হত্যাকাণ্ড কি জায়েজ ছিল? তার দ্বারা ঠিক কোন কথাগুলো বলা হয়েছিল?  

আসুন সংক্ষিপ্তভাবে সেই ঘটনাটি আগে দেখি:-

একজন ব্রাহ্মণ তার মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে রামের প্রাসাদের ফটকে এসে কাঁদতে কাঁদতে বার বার চিৎকার করে উঠলেন। তার ছেলেটি তখনও কৈশোরে পৌঁছায়নি তার আগেই তার মৃত্যু ঘটেছে। তিনি বললেন রামের রাজত্বে মানুষের অকালমৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা আমি আগে কখনও দেখিনি বা শুনিনি। রাম নিশ্চয়ই গুরুতর দোষ করেছেন তাই তাঁর রাজ্যে শিশুর অকালমৃত্যু ঘটেছে। হে মহারাজ, মৃত্যুর কবলে পড়া আমার সন্তানের জীবন ফিরিয়ে দাও! নয়তো আমার স্ত্রীর সাথে আমি তোমার দরজায় আমাদের জীবন ত্যাগ করব। একজন পাপাচারী রাজার অধার্মিক শাসনে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। একজন রাজার মন্দ আচরণ তার প্রজাদের অকাল মৃত্যু ডেকে আনে। 
হতভাগ্য পিতা তার পুত্রকে তার বুকের সাথে আঁকড়ে ধরার সময় রাজাকে সম্বোধন করেছিলেন এমন অগণিত অভিযোগে র মাধ্যমে।

রাম তখন তার রাজ্যের প্রবীণ ও মহান সাধুদের সাথে পরামর্শ করলেন যে শিশুটির অকালমৃত্যুর কারণ কী হতে পারে, এবং তারপর ঋষি নারদ বললেন:- 

"ত্রেতাযুগে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের তপস্যার অধিকার আছে বাকি বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণীর জন্য উপযুক্ত নয়। দ্বাপর যুগে বৈশ্য শ্রেণীর লোকেরা তপস্যার অধিকার পাবে আর শুধুমাত্র কলিযুগেই শূদ্র বর্ণের জন্য তপস্যা অনুমোদিত।
এই সময়ে, আপনার সাম্রাজ্যে, একজন হতভাগ্য শূদ্র, কঠোর তপস্যা করছে, হে রাজকুমার এটিই সেই শিশুর মৃত্যুর কারণ।

অধার্মিকতার অনুশীলন, তা শহর বা দেশেই হোক না কেন, দুর্ভাগ্য ডেকে আনে এবং যে সম্রাট তাৎক্ষণিক শাস্তির মুখোমুখি হন না, তিনি নরকে যান, এতে কোন সন্দেহ নেই।

হে রাজা, আপনি আপনার রাজ্যের ঘটনাগুলি তদন্ত করুন এবং যেখানেই এটি অনুশীলন করা হচ্ছে সেখানে দয়া করে এই অপকর্মটি বন্ধ করুন, যাতে ধার্মিকতা বিকাশ লাভ করতে পারে, মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত হয় এবং শিশুটিকে পুনরায় জীবত করুন।"

তারপর রাম সেই শূদ্র তপস্বীর সন্ধানে গেলেন তিনি দেখতে পেলেন এক তপস্বীকে উল্টো হয়ে ঝুলে চরম তপস্যা করছে। তখন রাম তাকে তার তপস্যার উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন সেই তপস্বী উত্তর দিলেন যে তাঁর নাম শম্বুক এবং তিনি শূদ্র বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি তাঁর নশ্বর দেহে দেবত্ব লাভের জন্য (অর্থাৎ স্বয়ং দেবতা হওয়ার জন্য) তপস্যা করছেন এবং তিনি স্বর্গ জয় করতে চান।

রাম তখনি তার তলোয়ার নিয়ে তার মাথা কেটে ফেললেন। শূদ্র নিহত হওয়ার সাথে সাথে স্বর্গ থেকে সমস্ত দেবতা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “সাবাশ! সাবাশ!" রাম প্রশংসায় অভিভূত, এবং স্বর্গীয় পুষ্প বর্ষণ চারদিকে।

রাম তখন ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করলেন এবং সেই ব্রাহ্মণের পুত্রকে পুনরায় জীবত করতে বললেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সেই ব্রাহ্মণকে তার পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেবেন।

ইন্দ্র বললেন যে শিশুটি নতুন জীবন পেয়েছে এবং তার পিতামাতার কাছে ফিরে গেছে। শূদ্রের মাথা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে শিশুটি পুনরায় জীবত হয়েছিল।

আসুন শাস্ত্রের প্রতিটি শব্দে বিশদভাবে দেখি সেই শূদ্র তপস্বীকে হত্যার সঠিক কারণ কী ছিল?

সম্বুককে হত্যা করা হয়েছিল শুধুমাত্র শুধু তার জাত বা তপস্যার কারণে নয়। সমাজের জন্য ক্ষতিকর তামসিক তপস্যায় নিযুক্ত থাকায় তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
রামায়ণ অনুসারে, সম্বুক তার শারীরিক দেহে স্বর্গে পৌঁছে দেবতা হতে চেয়েছিলেন। শম্ভুক আরও বলেন যে তিনি দেবলোকে জয় করার জন্য তপস্যা করছিল।

যে বিষয়টি প্রায় সকলেই মিস করেন তা হল শম্বুকের তপস্যার উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভগবান রাম শুধু তাঁর জাত কি জিজ্ঞাসা করেননি, এই চরম তপস্যার পেছনের কারণ কী, এর মাধ্যমে তিনি কী অর্জন করতে চান তাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তখন সেই তপস্বী শম্বুক উত্তর দিয়েছিলেন:-

"হে রাম, আমি শূদ্র বর্ণে জন্মেছি এবং এই মানব দেহে ভগবানের মর্যাদা লাভের জন্য আমি এই কঠোর তপস্যা করছি। আমি মিথ্যা বলছি না, হে রাম, আমি স্বর্গীয় অঞ্চল জয় করতে চাই। জেনে রেখো আমি শূদ্র এবং আমার নাম শম্ভুক।" 
(Valmiki Ramayana; Uttarakanda 75.2)

"আমি শূদ্র পরিবারে জন্মেছি; এবং কঠোর তপস্যা অবলম্বন করছি। হে রাম, আমি আমার দেহের সাথে ঈশ্বরত্ব পেতে চাই (অর্থাৎ আমি এই দেহ ত্যাগ না করে দেবতা হতে চাই)। হে মহারাজ, আমি মিথ্যা বলছি না, আমি দেবতাদের জগৎ জয় করতে চাই।"
(Padma Puran 1.35.83-84)

এখানে এটা জলের মতো পরিষ্কার বাল্মীকি রামায়ণ এবং পদ্ম পুরাণ উভয় অনুসারে যে শম্ভুক তাঁর নশ্বর দেহে দেবত্ব লাভের জন্য (অর্থাৎ স্বয়ং দেবতা হওয়ার জন্য) এবং স্বর্গ জয় করতে খুব উগ্র তাপস্যা করছিল।  
(Valmiki, Ramayana Uttarakanda; Sarga 75)

আরও, পদ্ম-পুরাণ (1.35.75-77) অনুসারে, রাম বলেছেন যে শম্ভুকের তপস্যা আসুরিক(অসুরদের তপস্যা) বলে মনে হয়েছিল, অর্থাৎ বিশ্ব ধ্বংসের জন্য। 

আসুরিক তপস্যা' ভগবদ্গীতা 17.5-6-এ বর্ণিত হয়েছে :-

"দম্ভ ও অহঙ্কারযুক্ত এবং কামনা ও আসক্তির প্রভাবে বলান্বিত হয়ে যে সমস্ত অবিবেকী ব্যক্তি তাদের দেহস্থ ভূতসমূহকে এবং অন্তরস্থ পরমাত্মাকে ক্লেশ প্রদান করে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ঘোর তপস্যার অনুষ্ঠান করে, তাদেরকে নিশ্চিতভাবে আসুরিক বলে জানবে।"

দেখুন কিভাবে তামসিক বা আসুরিক তাপস্যা বিষ্ণু পুরাণেও বর্ণিত শিশুমৃত্যু ঘটায়:-

"শাস্ত্র দ্বারা নির্দেশিত নয় এমন ভয়ঙ্কর তাপস্যা এবং শাসকদের অপকর্মের ফলস্বরূপ, শিশুরা তাদের শৈশবেই মারা যাবে।" (বিষ্ণু পুরাণ 6.1.40)

এখন আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে কারো তপস্যা কীভাবে অন্যদের মৃত্যু ঘটায়?
এই ধরনের ক্ষেত্রে কর্মফল কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করি:-

 "একজন ব্যক্তির কর্ম তার চারপাশের অন্যদের কর্মের সাথে যুক্ত। অন্যের ক্রিয়া কখনও কখনও নিজের কর্মফলের ফলস্বরূপ ট্রিগার বা অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। এই ক্ষেত্রে সন্তানের কর্মফল পিতামাতার সাথে ও অযোধ্যার জনগণ এবং রাজার সাথে যুক্ত। প্রজারা যেন ধর্ম পালন করে তা দেখা রাজার কর্তব্য। শম্বুক আসুরিক তপস্যা সম্পাদন করে ধর্ম লঙ্ঘন করেছিলেন এবং সময়মতো এটি পরীক্ষা করতে রাজার ব্যর্থতার কারণে শিশুটির প্রব্ধ কর্ম শুরু হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তার অকাল মৃত্যু ঘটায়।"

এখন আপনি জিজ্ঞাসা করবেন প্রব্ধ কর্ম কি? এটি আরেকটি বড় বিষয় আমি এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব না, শুধুমাত্র একটি সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দেব:-

"প্রব্ধ হল অতীত কর্মের সেই অংশ যা বর্তমানের জন্য দায়ী। সঞ্চিত কর্মের যে অংশটি বর্তমান মানবজীবনকে প্রভাবিত করে তাকে প্রব্ধ কর্ম বলা হয়। এটা এড়ানো বা পরিবর্তন করা যায় না। ইহাকেই আমরা নিয়তি বা ভাগ্য বলি, যা পূর্বে সংগৃহীত কর্ম দ্বারা গঠিত।"

আরেকটি মজার বিষয় হল বাল্মীকি রামায়ণ বালকাণ্ডে উল্লেখ আছে এমনকি রামের নিজের পূর্বপুরুষ রাজা ত্রিশঙ্কুও তার শারীরিক শরীর নিয়ে স্বর্গ লাভ করতে অক্ষম হয়ে ছিলেন যা তিনি করার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তাকে হত্যা করা হয়নি কারণ সে তার শারীরিক শরীরে ঈশ্বর হতে চায়নি এবং স্বর্গ জয় করতে চায়নি।

যদি শূদ্রদের জন্য তপস্যা নিষিদ্ধ হতো, তাহলে রাম শবরীকে ছেড়ে দিলেন কেন?
ভগবান রাম যদি সত্যিই শূদ্রদের তপস্যা পালনের বিরুদ্ধে ছিলেন তাহলে তিনি কেন শবরীকে হত্যা করেননি যিনি চরম তপস্বিনী আদিবাসী নারী ছিলেন? এমনকি বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে রাম তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।

বাল্মীকি রামায়ণে (3.74) সুস্পষ্টভাবে শাবরীকে শ্রমণী, তপস্বিনী এবং সিদ্ধা বলা হয়েছে।

শুধু তাই নয় শ্রাবণ কুমারের কথা মনে আছে যাকে রাজা দশরথ দুর্ঘটনাক্রমে হত্যা করেছিলেন এবং তার জন্য তার পিতা অন্ধ ঋষি দশরথকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে পুত্রশোকের কারণে তিনিও মারা যাবেন, সেই অন্ধ ঋষি ব্রাহ্মণ ছিলেন না তিনি ছিলেন বৈশ্য এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন শূদ্র উভয়েই তপস্বী ছিলেন। তাহলে তপস্যা করার জন্য কেউ তাদের বিরোধিতা করল না কেন? কারণ নারদের মতে ত্রেতাযুগে বৈশ্যরাও তপস্যা করতে পারত না।

এখানে বাল্মীকি রামায়ণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ যেখানে শ্রাবণ কুমার রাজা দশরথকে বলেছিলেন যে তিনি বৈশ্য পিতা এবং একজন শূদ্র মাতার পুত্র।👇

"হে দেশের রাজা! আমি ব্রাহ্মণ নই। আপনার মনে যেন কোন যন্ত্রণা না থাকুক। আমি একজন শূদ্র নারীর দ্বারা বৈশ্যের সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।" ( Valmiki Ramayana 2.63.56 )

তাহলে প্রশ্ন আসে শম্বুক ঘটনার সময় নারদ কেন বলেছিলেন যে ত্রেতাযুগে শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রাই তপস্যা করার অধিকারী ছিলেন? দেখা যাক। 

বেদান্তসূত্রে শ্রীকারের ভাষ্য (1. 3. 34):- অনুসারে
 সন্ন্যাসের আদেশ, এবং অদ্ভুত নিয়মগুলো যে গুলো বৈদিক গ্রন্থ দ্বারা প্রস্তাবিত, শুধুমাত্র তিনটি বর্ণের( ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ) জন্য, কিন্তু নিছক 'ন্যাস' ( পার্থিব আনন্দ ও কামনা-বাসনা পরিত্যাগ ) নারী, শূদ্র এবং মিশ্র জাতি দ্বারা অবলম্বন করা যেতে পারে।

অর্থাৎ বৈদিক গ্রন্থে উল্লিখিত সন্ন্যাসের জন্য চরম কঠিন নিয়মগুলি শুধুমাত্র প্রথম তিনটি বর্ণের জন্য ছিল এবং শূদ্র, মহিলা এবং মিশ্র-বর্ণের লোকদের জন্য নয়, তারা এই ধরনের চরম নিয়ম অনুসরণ না করেই তপস্যা করতে পারে যাকে "ন্যাস" বলা হয়।

সারসংক্ষেপ:-

 - শম্বুক ভগবান হতে চেয়েছিলেন
 - শম্বুক দেবতাদের বিশ্ব জয় করতে চেয়েছিলেন
 - শম্বুকের উগ্র তপস্যা একটি শিশুর মৃত্যু ঘটায়
 - এটা অনুমান করা হয় যে স্বধর্ম অনুসরণ না করা প্রকৃতি এবং প্রকৃতির অন্যদের প্রভাবিত করে। তার তপস্যা একজন নিরীহ ব্রাহ্মণের মৃত্যুর সাথে জড়িত।
- শ্রী রাম শূদ্রদের কল্যাণের বিরুদ্ধে নন। তিনি উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ভুল বিধি ব্যবহার করে এমন লোকদের বিরুদ্ধে, যা প্রক্রিয়ায় অন্যদের ক্ষতি করে যারা নির্দোষ।

✍️গৌরব দে

Comments

Popular posts from this blog

Full analysis of child marriage and Pedophilia in Hinduism.

Mahabharat historicity

Do u believe in Rebirth ?