ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
[রাসলীলা সম্পর্কে দৃষ্টিপাত]
রাসলীলার ঘটনাটি ঘটেছিল শরৎ কালের রাতে যখন বৃন্দাবনের গোপীরা কৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ শুনে তাদের গৃহ-পরিজনদের ছেড়ে বনের দিকে কৃষ্ণের সাথে রাতভর আধ্যাত্মিক পরমানন্দে নৃত্য করার জন্য ছুঁটে যায়।
কৃষ্ণ ভক্তি পরম্পরায়, রাস-লীলাকে আত্মাপূর্ণ প্রেমের অন্যতম সুন্দর চিত্র বলে মনে করা হয়। যেখানে আধ্যাত্মিক ভক্তির অমৃতের বর্ণনা করা হয়েছে।
ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি বিশ্বস্তভাবে রাসলীলা শ্রবণ করে বা বর্ণনা করে সে ভগবান কৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেমময় ভক্তি (সুদ্ধ-ভক্তি) লাভ করিবে এবং কামবাসনা যা মনের সবচেয়ে বড় রোগ সেটাকে পরাজিত করিতে সক্ষম হইবে। (ভাগবত পুরাণ 10.33.39)
ঈশ্বর হলেন পরমাত্মা এবং আমাদের জীবাত্মা হল সেই পরমাত্মার প্রতিবিম্ব, যা আমরা ধারণ করি।
ঈশ্বর পৃথিবীর সকলের মধ্যে বাস করেন তাই প্রভু নিজেই নিজের প্রতিবিম্ব নিয়ে যেন খেলেন, ঠিক যেমন একটি শিশু আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে নিজের ইচ্ছায় খেলা করে, তেমনি ঈশ্বর তার নিজের যোগমায়ার সাহায্যে গোপীদের সাথে খেলা করেছিলেন, যাদেরকে তার নিজেরই রূপের প্রতিবিম্ব বলে মনে করা হয়েছে।
কিন্তু কিছু মূর্খ আছে যারা এই ঘটনা নির্বোধভাবে ভুল ব্যাখ্যা ধরে ভগবান কৃষ্ণের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। এই মিথ্যা চিরতরের জন্য আজ ভাঙ্গা যাক। শাস্ত্রীয় বর্ণনা ও ব্যাখা আর কিছু অজানা তথ্য রাসলীলার সম্পর্কে নিয়ে আজকের লেখাটি। একটু বড় হলেও হতে পারে লেখাটি, তবে অনুরোধ রইল সকলের কাছে শেষ অবধি পড়বেন নাহলে অনেক কিছু মিস করবেন।
[প্রথমে ঐতিহাসিক বা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ/(materialistic reading) দিয়ে ঘটনাটি দেখা যাক]:-
এটা অনেকেই জানে না যে রাসলীলার সময় তখন ভগবান কৃষ্ণের শারীরিক বয়স মাত্র 9 বছর বয়সী একটি শিশু, সুতরাং তার বিরুদ্ধে যৌনতার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, যদি কেউ স্কুল জীবনে সামান্য জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে থাকে সে সহজেই বুঝতে পারবে এই অভিযোগ কতটা ভিত্তিহীন।
প্রমাণ :- কৃষ্ণ যখন মথু্রায় গিয়ে কংসকে হত্যা করেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র 11 বছর ছিলো, আর রাসলীলার ঘটনাটি কংস বধ-এর অনেক আগের ঘটনা যখন তিনি বৃন্দাবনে নিজের শৈশবের দিনগুলো কাটিয়ে ছিলেন।
আমরা ভাগবত পুরাণ 3.2.26-এ এর প্রমাণ পাই যেখানে বলা হয়েছে কৃষ্ণ মাত্র এগারো বছর নন্দ বাবার ঘরে ছিলেন জন্মের পর।
ভাগবত পুরাণ 3.2.26
ततो नन्दव्रजमित: पित्रा कंसाद्विबिभ्यता ।
एकादश समास्तत्र गूढार्चि: सबलोऽवसत् ॥ २६ ॥
ভাগবত পুরাণ 10.26.14
क्व सप्तहायनो बाल: क्व महाद्रिविधारणम् ।
ततो नो जायते शङ्का व्रजनाथ तवात्मजे ॥ १४ ॥
কৃষ্ণ বৃন্দাবনে যখন গোবর্ধন পর্বত তুলে নিয়েছিলেন সেই সময় ভাগবতে বর্ণিত তাঁর বয়স ছিল মাত্র 7 বছর।
রাসলীলার ঘটনা গোবর্ধনলীলার থেকে দুই বছর পরে ঘটেছিল যখন তার বয়স ছিল মাত্র 9 বছর।
তাহলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়ে আর তর্ক করা মানে সময়ের অপচয়, এখন এই রাসলীলা ঘটনাটি ট্রেডিশনাল ব্যাখার দৃষ্টি থেকে দেখা যাক।
পরম্পরায় রাসলীলার বর্ণনা ও ব্যাখা:-
ভাগবত পুরাণ বেশিরভাগটাই ভক্তি যোগের উপর ভিত্তি করে লেখা, যারা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সামান্য হলেও পরিচিত তাঁরা জানেন যে হিন্দুধর্মের পরম লক্ষ্য হল মোক্ষলাভ অর্থাৎ ঈশ্বর লাভ করা যা আত্মাকে প্রকৃতির বন্ধন অর্থাৎ জীবন মরণ এর চক্রের থেকে মুক্তি দেয়। যার জন্য ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন মার্গ দর্শন করানো হয়েছে, তার মধ্যে ভক্তি যোগ হল অন্যতম। এবাদে কর্ম যোগ, জ্ঞান যোগ, রাজ যোগের বর্ণনা শাস্ত্রে আছে।
আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলিতে বর্ণিত ভক্তিভাবের বিভিন্ন রূপ বর্ণনা রয়েছে যেমন সখাভাব, দাস্যত্ত্বভাব, বাতৎসল্যভাব, মাধূর্যভাব ইত্যাদি। রাসলীলা শেষেরটা মানে মাধূর্যভাবের প্রর্দশন করে।
এসবের বিস্তারিত বিবরণে যাবো না তাহলে এই লেখাটি অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে সংক্ষেপে আমি ব্যাখ্যা করছি, আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে।
"মাধূর্যভাব":- এটি হয় প্রেমিকের প্রতি একজন প্রেমিকার যা মনোভাব, সেইভাবেই ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা। কৃষ্ণের প্রতি রাধার বা অন্যান্য গোপীদের এই মনোভাব ছিল। এই ভাব একটি স্ত্রী ও তার স্বামীর প্রতিও অনুভব করে।
উদাহরণ:- মীরাবাই কৃষ্ণকে স্বামী হিসেবে পূজা করতেন। কৃষ্ণের সাথে তার মাধূর্যভাবের সম্পর্ক ছিল।
আমাদের আজকের আলোচিত বিষয়বস্তুটি এই ভাবের সাথে সম্পর্কিত।
"বাৎসল্য ভাব":- এটি সন্তানের প্রতি মায়ের যা মনোভাব বা ভালোবাসা সেটাকে বোঝায়। ভগবানকে নিজের ছেলের রূপে ভালোবাসা, সেটাই হচ্ছে বাৎসল্যভাব। এর ভালো উদাহরণ হচ্ছে কৃষ্ণের প্রতি তার মা যশোদার যে মনোভাব।
"সখাভাব":- বন্ধুত্বের মনোভাব। শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল কৃষ্ণের প্রতি সুদামার ভক্তি।
"দাস্যত্ত্বভাব":- এটি ভগবানকে নিজের মালিক ও নিজেকে তার দাস রূপে মেনে ভক্তি করা।
এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল হনুমান ও শ্রীরামের সম্পর্ক।
এবার আলোচনা করা যাক রাসলীলা শব্দের অর্থ সম্পর্কে:-
ভাবার্থ দীপিকাতে ব্যাখ্যা রয়েছে যে "রাস" হল 'একটি প্রবল ভালোবাসা বা ভক্তি'। যেমন ভাগবত পুরাণ ৩.৭.১৯- এ বর্ণিত:- 'কৃষ্ণের কমল চরণে ভক্তির সেবা।'
ভাগবত পুরাণে রাসলীলার বর্ণনার কিছু শ্লোক তুলে ধরছি:-
কৃষ্ণের মিষ্টি বাঁশির সুর যা গোপীদের কৃষ্ণের প্রতি ভালবাসার অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তুলেছিল যা তাদের নিজেদের প্রতি আত্মচেতনা সম্পর্কে বিস্মৃতি ঘটিয়েছিল, ব্রজের মেয়েরা যাদের হৃদয় কৃষ্ণের দ্বারা বিমোহিত হয়েছিল তখন তারা অন্যরা এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা কি করছে তারা আর সেই দিকে মনোযোগ দিয়ে থাকতে পারলো না। তারা তাদের সখীদের সাথে ছুটে পৌঁছেছিল ব্রজভূমিতে। তাদের সোনার কানের দুল তাদের দ্রুত গতিতে কানে অফুরন্ত ভাবে দুলতে লাগিল, অবশেষে তারা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো যেখানে তাদের বংশিধারী প্রেমিক( কৃষ্ণ) অপেক্ষা করছিল। (ভাগবত পুরাণ 10.29.4)
কৃষ্ণের শুধু নাম শ্রবণ করলেও যেমন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ভক্তরা অন্য সমস্ত কাজ ত্যাগ করে কৃষ্ণের ভক্তিতে ডুবে যায়, ঠিক তেমনি গোপীদের ও সেই হাল। তাঁরাও তাদের কাজকর্ম অর্ধেক ফেলে রেখেই কৃষ্ণের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।
যদিও তাদের স্বামী, পিতা, ভাই এবং আত্মীয়দের দ্বারা তাদের বাঁধা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ভগবান কৃষ্ণের দ্বারা যে তাদের হৃদয় প্রলুব্ধ ও সম্মোহিত হয়েছিল তাদের কি আর আটকে রাখা সম্ভব।, তাদের মন যে আর কিছুতেই কৃষ্ণের মায়ার থেকে বেরোতে পারেনি।
কিছুজনকে তাদের বাড়ির লোকজন ভিতরের ঘরে বন্দী করে দিয়েছিল যাতে তারা বাইরে বেরোতে না পারে। তখন তারা তাদের চোখ বন্ধ করে ভগবান কৃষ্ণের ভক্তিতে মগ্ন চিত্তে ধ্যান করতেন।
গোপিদের শারীরিক চেতনা বর্জিত হয়ে গিয়েছিল এবং তারা আধ্যাত্মিক স্তরে গিয়ে কৃষ্ণের সাথে দেখা করেছিল। সুতরাং এটি সম্পূর্ণ ভৌতিক জগতে ঘটিত ঘটনা নয়, কারণ বর্ণনাগুলি সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক জগতের বর্ণনাও প্রকাশ করে।
এটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় ভাগবত পুরাণের শ্লোক 10.33.38 উল্লেখ দেখলে যেখানে বলা হয়েছে যে গোপিরা যখন রাসলীলায় মগ্ন ছিলেন, তখন তাদের বাড়ির লোকেরা তাদের বাড়িতেও খুঁজে পেয়েছিল।
ভাগবত পুরাণ 10.33.38:-
नासूयन् खलु कृष्णाय मोहितास्तस्य मायया ।
मन्यमाना: स्वपार्श्वस्थान्स्वान्स्वान्दारान् व्रजौकस: ॥
"ব্রজের পুরুষেরাও ভগবানের যোগমায়ার বলে এতটাই মোহিত হয়েছিলো যে তারা সর্বদা তাদের স্ত্রীদেরকে তাদের পাশে উপস্থিত বলে মনে করতেন। তাই ভগবান কৃষ্ণের প্রতি তারা কখনোই ঈর্ষা অনুভব করেননি।"
এই আধ্যাত্মিক ঘটনার উপাদানটি রাসলীলার একেবারে শুরুতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যেখানে বলাই হয়েছে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ নিজেই নিজের যোগ-মায়ার দ্বারা রাসলীলাতে অংশ গ্ৰহন করেছিলেন।(ভাগবত পুরাণ 10.20.1)
আপনারা সকলেই হয়তো সন্ত একনাথের নাম শুনেছেন। সেই ভক্তিমূভমেন্টের ১৬ই শতাব্দীর বিখ্যাত সন্ত ছিলেন। সেইসন্ত একনাথ নিজের ভাগবত ভাষ্যেও ব্যাখ্যা করেছেন যে কৃষ্ণ কোনো গোপীর বাড়িতে নিজে যাননি কিন্তু যখনই কোনো গোপী কৃষ্ণের প্রতি মনে মনেই অনুরাগ অনুভব করতো বা তাকে স্মরণ করতো, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাদের তৎকালীন মানসিকভাবে সন্তুষ্ট করতেন মনের মাধ্যম্যেই। ঠিক যেমন একটি পরশ পাথরের স্পর্শে এক টুকরো পাথর সঙ্গে সঙ্গে সোনাতে রূপান্তরিত হয়, ঠিক সেভাবেই মানসিক যোগাযোগের মাধ্যমেই কৃষ্ণের ছোঁয়া গোপীদেরকে পরম ভক্তে রূপান্তরিত করেছিল এবং সকলেই ব্রহ্মে লীন হয়েছিলেন। পবিত্র জিনিষের সংস্পর্শ সত্যিই পবিত্র। (একনাথী-ভাগবত 12.191-214)
ভগবান নারায়ণ নিজেকে যখন প্রকাশ করেন তার ভক্তদের কাছে তখন তার ভক্তদের স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহ বিনষ্ট হয় এবং ভক্তকে রাসলীলা বা ঐশ্বরিক লীলার অনুভূতি উপভোগের জন্য উপযুক্ত দেহ প্রদান করেন (কারণ আমাদের সাধারণ নস্বর দেহ প্রকৃতির মায়াজালে আবদ্ধ, ইন্দ্রিয় ও মন তাদের সীমা সাধারণত অতিক্রম করতে পারে না। তাই আধ্যাত্মিক সুখ উপলব্ধি করার জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত নয়)। তারপরে সেই ভক্ত সেই রাসলীলার পবিত্র দিব্যভূমীতে প্রবেশ করে যা অনন্তকাল চলতে থাকে। এটাই মোক্ষ(সালোক্য মুক্তি)। (বালকৃষ্ণ ভট্টের—প্রেমেয় রত্নাকর ৩৯-৪৪)
[অর্থাৎ রাসলীলা শুধুমাত্র অতীতে ঘটে যাওয়া বা ইতিহাসের পাতায় বন্দী কোনো এক ঘটনা নয়। কোনো মহান সাধক বা ভক্ত চাইলে সেই রাসলীলা নিজেরাও উপলব্ধি করতে পারে। যদি তার সেই আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকে তবে সে যোগ সাধণার মাধ্যমে সমাধিতে(ধ্যানে চেতনার এক অবস্থা বিশেষ) গিয়ে সেই ব্রজভূমিতে রাসলীলা সরাসরি অনুভব করতে পারে। ধ্যানের সমাধিতে সাধক স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করে যায় আর তার জীবাত্মা ঈশ্বরে লীন হয়। ]
ভাগবত পুরাণ অবশ্য যেন জোর দিয়ে বলতে চায় যে গোপীদের সংযুক্তি ও আকর্ষণ কৃষ্ণের প্রতি শারীরিক যৌনতার আবেগ হতে পারে, তবে যে কোনও দৃঢ় অনুভূতি - সেটা যৌনতা, ঘৃণা বা স্নেহ যাই হোক না কেন ভগবানের দিকে এক মনে পরিচালিত হলে, শেষমেষ সেটা মোক্ষের দিকেই নিয়ে যায়। যেমনটি ভাগবত পুরাণ 7.1.28-29-এ বলা হয়েছে।
যারা যারা পরমেশ্বর শ্রী কৃষ্ণের প্রতি শত্রুতা জ্ঞাপন করে, তারাও তাকে লাভ করতে পারে। কারণ তীব্র ঘৃণা বা ভয়ের মাধ্যমেও তাঁরা প্রতিনিয়ত তাঁকেই অবিচ্ছিন্ন ভাবে স্মরণ করে ফলে যার কারণে তাদের সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে যায়।
কৃষ্ণকে সর্বদা শাস্ত্রে পরম যোগীর মর্যাদায় গণ্য করা হয়েছে কারণ তার ইন্দ্রিয়গুলি সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাকে তাই যোগেশ্বর নামেও সম্বন্ধিত করা হয়।
শাস্ত্রেই উল্লেখ্ রয়েছে যে ভগবান তার স্ত্রী, গোপালক-নারী বা অন্যদের সাথে মিশলেও তনি যৌন বিষয়ে সর্বদাই আত্মনিয়ন্ত্রণে ছিলেন কেউই তাকে বষিভূত করতে পারেনি।
রস-পঞ্চাধ্যায়ীতে তাকে 'কামদেব বিধ্বংসী' বলা হয়েছে। অর্থাৎ কামদেবও তাকে বষিভূত করতে ব্যার্থ বা তার কাছে পরাজিত। (ভাগবত পুরাণ 10.32.2.)
ভাগবত পুরাণ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে কৃষ্ণ গোপীদের সাথে মিশলেও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ সর্বদাই বজায় ছিল তার। (ভাগবত পুরাণ 10.33.26.)
তিনি গোপীদের প্রতি মোহগ্রস্থ কখনোই ছিলেন না। যখনই গোপীদের মনে অহংকার বোধ জন্ম নিতো এইভেবে যে তারা কৃষ্ণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাদের প্রতি আর চিরতরের জন্য তারা তাঁকে পেয়ে গেছে নিজের কাছে, তখনি কৃষ্ণ নিমিষেই রাসলীলার ভূমি থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। (ভাগবত পুরাণ 10.29.48)।
তিনি নিজেই নিজের আনন্দময় স্বরূপে আত্মতৃপ্ত ছিলেন, তিনি শুধু গোপীদের খুশি করার জন্য রাসলীলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
(ভাগবত পুরাণ 10.29.42.)
**এমনকি শাস্ত্রে এটাও স্পষ্ট করে বলা যে তার 16000 জন স্ত্রীও তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা, রূপ, গুণ, কৌশলের মাধ্যমেও তাকে মোহিত বা বষিভূতো করতে ব্যার্থ হয়েছিল। (ভাগবত পুরাণ 10.61.4.)
সন্ত একনাথ ভাগবত পুরাণের 11.12.10-13 শ্লোকের মন্তব্যে ভাষ্য করতে গিয়ে তিনি গোপীদের আধ্যাত্মিক প্রেম এবং তাদের প্রতি ভগবান কৃষ্ণের প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা করতে করতে এক আলাদাই আধ্যাত্মিক আনন্দে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। রাসলীলা এবং ভগবান কৃষ্ণের অন্যান্য খেলাধুলার সুন্দর বর্ণনাগুলি যে ভৌতিক জগতে সীমাবদ্ধ নয়। তাই এটিকে নিম্ন ভৌতিক জগতের শারীরিক যৌনতার সাথে তুলনা করা অত্যন্ত ভূল।
তাদের নিবিড় ভক্তি ও বিশুদ্ধ ভালবাসা যেকোনো সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে যে তারা নিজেদের সেই গোপীদের ঐশ্বরিক স্তরে নিয়ে যেতে পারে। গোপীদের সম্পর্ক ভগবানের সাথে কোনো ভৌতিক জগতের কামবাসনার অবধারণার দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখা অত্যন্ত ভূল। কারণ একনাথ স্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে গোপীদের কৃষ্ণকে পাওয়ার তৃষ্ণাই তাদের ভিতরের কামবাসনাকে নির্ভূলভাবে মিটিয়ে দিয়েছে। (একনাথী ভাগবত 12.153-157)।
গোপীরা নিজেরাও সেই কথাই বলেছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে :-
"হে প্রভু আপনার সেই কমল চরণ যা আপনি সেই কালিয়া নাগের মাথায় রেখেছিলেন সেই দুই চরণ আমাদের স্তনের উপরে রেখে আমাদের হৃদয় থেকে সমস্ত কামবাসনা নির্মূল করে দিন।" (ভাগবত পুরাণ 10.31.7)
ঈশ্বর যখনই কোনো লীলা করেন তখন সেই লীলার অনেক স্তরে অনেক রকম কারণ লুকিয়ে থাকে যা আমরা সাধারণ মানুষ সহজে ধরতে পারিনা।
পদ্ম পুরাণে বর্ণিত রয়েছে শ্রী কৃষ্ণের রাসলীলা ও ওগোপীদের শ্রী কৃষ্ণের প্রতি আকর্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে যা অনেকেরই কাছে অজানা। পদ্ম-পুরাণ; উত্তর-খন্ড; অধ্যায় ২৪৫:-
"ত্রেতাযুগে যখন ভগবান বিষ্ণু শ্রী রামচন্দ্রের রূপে অবতীর্ণ হন তখন গোপীরা তাদের পূর্বজন্মে দন্ডকবনের সমস্ত ঋষিগণ ছিলো। তারা শ্রী রামের অপরুপ সৌন্দর্যের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলো যে তারা নিজেরা নারী হতে চেয়েছিলো আর সেই নারী দেহে ভগবানকে সেবা করতে চেয়েছিল। যেহেতু ভগবান কখনো তার ভক্তদের মনের ইচ্ছা অপূর্ন রাখেন না। সেই কারণেই সেই ঋষিরাই পরবর্তী জন্মে নারী দেহে গোপীদের রূপে জন্মগ্রহণ করেছিল আর ভগবান বিষ্ণু শ্রী কৃষ্ণের রূপে অবতীর্ণ হয়ে তাদের সেই মনোকামনা পূর্ণ করেছিলেন।"
তাই, সংক্ষেপে এটাই বলা যেতে পারে যে, গোপীদের জীবাত্মার অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষা পরমাত্মার(কৃষ্ণ) কাছে যাওয়ার জন্য এতই তীব্র এবং শক্তিশালী ছিল যে শারীরিকভাবে তা ভগবানের প্রতি মাধুর্যভাব ভক্তির দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল এবং শেষে তাদের জীবাত্মা মুক্তি লাভ করে।
যেমন পদ্ম-পুরাণ ৬.২৪৫.১৬৮ উল্লেখ আছে:-
कामाद्भयाद्वा द्वेषाद्वा ये भजंति जनार्दनम् ।
ते प्राप्नुवंति वैकुंठं किं पुनर्भक्तियोगतः ॥ १६८ ॥
"যারা এমনকি কাম, ভয় বা ঘৃণার মাধ্যমেও সারাক্ষণ বিষ্ণুর চিন্তন করে তাঁরাও শেষমেষ বৈকুণ্ঠ লাভ করতে পারে। তাহলে তো যারা ভক্তি করে সারাক্ষণ ভগবানকে স্মরণ করে তাদের কথা কি আর বলার!"
কেউ এবার প্রশ্ন করতে পারেন যে কি করে ভগবানের প্রতি ঘৃণাও মুক্তি বা বৈকুণ্ঠ লাভ করাতে পারে ?
উত্তর:- ঠিক যেমনভাবে শিশুপাল, হিরণ্যকষিপূ ইত্যাদি রাক্ষস, দৈত্য মুক্তি লাভ করেছিল। কারণ ভগবানের হাতে মৃত্যুও সৌভাগ্যজনক। বাস্তবে সেই মৃত্যুও যে মৃত্যু নয় বরং মুক্তির পথ হয়ে যায়। খালি তফাৎ থাকে কেউ ধ্রুব বা প্রহ্লাদ এর মতন ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বররের আশীর্বাদ লাভ করে তো কেউবা শিশুপাল ও হিরণ্যকষিপূর মতন ঈশ্বরের প্রকোপের সম্মূখীন হয়। কিন্তু ঈশ্বরের করুণার আশ্রয় থেকে কেউই বঞ্চিত হয় না যা অবশেষে মুক্তির পথেই আত্মাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আজকের আলোচনাটি ভাগবত পুরাণের একটি শ্লোক দিয়ে এখানেই শেষ করবো। কমেন্টে জানাবেন কেমন লাগলো লেখাটি পড়ে। যদি কোনো বাংলা শব্দের বানানের ভূল হয়ে থাকে কারণ আমি ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র ছিলাম তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী।
"ভগবান যখন তাঁর ভক্তদের প্রতি করুণা বর্ষণের জন্য একটি মানব দেহ ধারণ করেন, তখন তিনি এরকম লীলা করেন, যাতে তার এইরূপ লীলার বর্ণনাগুলো যারা শ্রবণ করে তারা তার প্রতি আকর্ষিত হয়ে নিজেকে তার কাছে উৎসর্গ করতে পারে।"-(ভাগবত পুরাণ 10.33.36.)
✍️ গৌরব দে।
Comments
Post a Comment